জনমত রিপোর্ট : বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিকমানের করে গড়ে তুলতে বিশ্বব্যাংক বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক পাঠদানে বিদ্যালয়গুলোতে আলাদা শেণিকক্ষ গড়ে তালা হবে। সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায়।
এজন্য সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলছে বিশ্বব্যাংক। বায়োটেকনোলজি ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। এছাড়া বাংলাদেশের চলমান প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক আগের চেয়ে বেশি অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কট উত্তরণেও আর্থিক সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকারও ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কত অর্থের প্রয়োজন হবে তা চূড়ান্ত করতে শীঘ্রই বৈঠক করবে সংস্থাটি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সদর দফতরে সংস্থা দুটির বসন্তকালীন সভা শুরু হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে সংস্থা দুটি বিভিন্ন প্রকল্পে সহায়তা বাড়ানোর কথা জানিয়ে দিয়েছে। তবে সরাসরি অর্থায়নের মাধ্যমে বেশি সহযোগিতা করতে চায় শিক্ষায়।
সংস্থা দুটি বলছে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এছাড়া প্রতিবছর শিক্ষার হার বাড়ছে। তবে এখন ছাত্রছাত্রীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তাদের উন্নত বিশ্বের ন্যায় শিক্ষা অর্জন করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী বিষয়ভিত্তিক শিক্ষায় নিজেকে গড়ে তুলবে।
এসব বিষয়ে জোর দিয়ে অর্থমন্ত্রীও বিশ্বব্যাংকের কাছে আর্থিক সহায়তা চান। বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন অশিক্ষিত মানুষ নেই বললেই চলে। সবাই স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন। তবে এটি শিক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। ছাত্রছাত্রীদের সুশিক্ষায় শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, যাতে তারা নিজেদের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য কিছু করতে পারে। এজন্য প্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজি ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক সব ধরনের আর্থিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দাতা সংস্থাদের ঋণ পরিশোধে সুনাম অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ফলে আগামীতে এসব খাতে আরও সহায়তার বাড়ানোর আশ্বাস দেয়া হয়েছে।’
এদিকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বৈঠকে গুরুত্ব পায় রোহিঙ্গাদের সমস্যা। সেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের সঙ্কট না কাটতেই আগামী বর্ষায় আরও সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। কারণ পাহাড়ের গায়ে রোহিঙ্গাদের বাসস্থান। বর্ষায় পাহাড় ধসে সঙ্কট আরও বাড়তে পারে। এটিও বড় এই দাতা সংস্থার কাছে তুলে ধরা হয়।
বৈঠক শেষে এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, ‘বিশ্বব্যাংকের সিইওর সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংস্থাটি তাদের আর্থিক সহায়তা করবে। অতীতের মতোই রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।’
বর্ষার মৌসুমে পাহাড় ধসে রোহিঙ্গাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এ অবস্থায় তাদের জন্য কোন সহায়তা চাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সার্বিক অবস্থা থেকে বিশ্বব্যাংকের লোকজন সেখানে আছে। পৃথক ডেস্কও আছে বিষয়টি দেখভালের জন্য। আমি বিশ্বাস করি রোহিঙ্গা সঙ্কট হলে বিশ্বব্যাংক তা দেখবে।’
পদ্মা সেতু ছাড়া অন্যান্য বড় প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। সেটি তুলে ধরা হয়েছে সম্মেলনে। এছাড়া উন্নয়নের গতি ধরে রাখতে আগামীতে আরও বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। সম্মেলনে এমন ধারণা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে। এ বক্তব্যের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, যথা সময়ে এসব প্রকল্প শেষ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান অনেক প্রকল্প চলছে। শেষ হওয়ার পথে আছে অনেক প্রকল্প। বড় প্রকল্পও কিছু চলমান রয়েছে। এসব বড় প্রকল্পগুলো শেষ করতে হবে। আর তার করতে দরকার অর্থায়ন। তবে বিশ্বব্যাংক ছাড়া অন্য দাতা সংস্থা যা আমাদের অর্থায়ন করছে তারা অনেক চাপের মুখে আছে। কারণ সারা বিশ্বে অর্থনীতি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এ দিক থেকে বাংলাদেশ চাপ মুক্ত। কারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পৃক্ততা খুব কম। এরপরও আমরা বেশি অর্থ চেয়েছি। তারা এতে দ্বিমত করেনি। প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক অর্থেও যোগান দিতে রাজি আছে।’
বড় প্রকল্প বলতে নির্ধারিত কোন প্রকল্পের নাম বলতে পারবেন কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু ছাড়া অনেক প্রকল্পেই সহায়তা নেয়া হবে এবং আগামীতে অনেক প্রকল্প আসবে সেগুলোতে সহায়তা নেয়া হবে।’
বড় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হতে পারে এবং এ সংক্রান্ত হিসাব সরকার তৈরি করেছে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যত অর্থ লাগবে এটি ঠিক করতে বিশ্বব্যাংক কাজ করছে। বিষয়টি চূড়ান্ত করতে বিশ্বব্যাংক বৈঠক করবে। তবে তারা অনেক সহজ করে দিয়েছে। বিশেষ করে সেসব প্রকল্পের অগ্রগতি কম, সেখানকার অর্থ অন্য প্রকল্পে ব্যবহারের অনুমোদিত দিয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আগে যে সহায়তা পাওয়া গেছে তার চেয়ে বেশি সহায়তা পাওয়া যাবে। কারণ ইতোপূর্বে নেয়া ঋণ সঠিক সময়ে পরিশোধ করা হয়েছে। এ দিক থেকে বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। শিক্ষা খাত সংস্কারে বড় ধরনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষা খাতে সংস্কারমুখী পদক্ষেপের মধ্যে বর্তমান যে সাধারণ মানের শিক্ষা আছে এর পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান ও আগামীর হাল ধরতে পারবে সে মানের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন। এজন্য বিষয়ভিত্তিক শ্রেণিকক্ষ সাজাতে হবে। অনেক অর্থেও প্রয়োজন হবে। সংস্কারমুখী পদক্ষেপ না নিলে এগোতে পারব না।’
বর্তমান মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও হার নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সিইও কোন প্রশ্ন করেছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘জিডিপির প্রবৃদ্ধির জন্য যেসব সহায়ক দরকার সেগুলো আমাদের আছে। এগুলোর হাত ধরেই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। সুতরাং তারা জেনেই প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে বিরোধিতা করেনি।’
প্রসঙ্গত, অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোকে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ নাম দেয়া হলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। ১০ বড় প্রকল্পের মধ্যে সাতটিতে ‘এ’ অর্থবছরের মূল এডিপিতে ২৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ছাড়া বাকি সাত প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশও শেষ হয়নি।
জানা গেছে, আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হবে। এবার বেশকিছু নতুন প্রকল্প আসার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে গ্রাম হবে শহর কর্মসূচী সামনে রেখে বড় বড় কিছু প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। এসব প্রকল্পের মধ্যে রাস্তাঘাট পাকা করা, বিদ্যুত, জ্বালানি, স্যানিটেশন পয়োনিষ্কাশনের মতো প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নেও বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।
এম শাহজাহান, ওয়াশিংটন ডিসি।