রাশেদ আহমদ খান, হবিগঞ:সুখিয়া রবিদাশ। হবিগঞ্জের দলিত সম্প্রদায়ের এক হতভাগ্য বিধবা। যাকে সম্ভ্রম হারানোর পর প্রাণও দিতে হয়েছে দুর্বৃৃত্তদের হাতে। প্রকাশ্য দিবালোকে জনবহুল রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় সুখিয়াকে। এর আগে তার স্বামী ও ভাইকেও নৃশংসভাবে হত্যা করে একই সন্ত্রাসীরা। এছাড়া পরিবারের নিরীহ নারীদের উপর প্রতিরাতে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এসব নির্যাতনের পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য দলিত সম্প্রদায়ের ভিটে-বাড়ি উচ্ছেদ করে মার্কেট নির্মাণ। আর দীর্ঘদিন থেকে পরিকল্পিতভাবে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে চলছে স্থানীয় একটি ভূমিখেকো চক্র। সুখিয়ার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলছে আন্দোলন। রবিদাশ সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সোচ্চার হয়ে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে। তবে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীরা এখনো রয়ে গেছে অধরায়।
সুখিয়া হত্যার পর তার বোন সোমা রবিদাশ বাদী হয়ে ৮ জনকে আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রধান আসামি শাইলু এখন জেলহাজতে। তবে ধরা পড়েনি এসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক ভূমি খেকোরা। তারা প্রতিদিনই প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে সুখিয়ার পরিবারকে। গভীর রাতে এখনো হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সুখিয়ার পরিবার। পরপর তিনটি প্রাণের বিনিময়েও রক্ষা পাচ্ছে না দলিত সম্প্রদায়ের বসতভিটা। চরম নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্কে তারা ভিটেবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র অবস্থানের কথা ভাবছে তারা। সরজমিনে সদর উপজেলার সুতাং গ্রামে দলিত সম্প্রদায় রবিদাশ পল্লীতে গিয়ে জানা যায় এসব লোমহর্ষক তথ্য।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুখিয়ার পূর্বপুরুষদের সুতাং নদীর পাড়ে বসতি করার ব্যবস্থা করে দেন সুরাবই গ্রামবাসী। তখন সুখিয়ার বাবা লাল চান ও চাচা সাম লাল সুতাং নদীর ব্রিজের পাশে ৮ শতক ভূমিতে মাটির বসতভিটা তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৩ সালের দিকে সুখিয়াদের বাড়ির উপর দৃষ্টি পড়ে পার্শ্ববর্তী ভূমির মালিক সুরাবই গ্রামের আঃ ওয়াদুদ খান, আঃ হামিদ খান ও আঃ আহাদ খানের। ওই সময় পরিকল্পিতভাবে লালচানের ঘর ভেঙে দেন তারা। এ সময় স্থানীয়রা পরিবারটির পাশে দাঁড়ান। গ্রামবাসী বাজারে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। প্রশাসন ও গ্রামবাসীর চাপে অবশেষে হামিদ খান ও তার ভাইয়েরা পুনরায় সুখিয়াদের ঘর তৈরি করে দিতে বাধ্য হন। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই নিরীহ পরিবারটির ওপর নির্যাতন করতেন ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে। ২০১৬ সালে ১৯শে অক্টোবর সুখিয়ার ভিটাতে একটি এনজিও ঘর তৈরি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। ঘর তৈরিতে প্রকাশ্যে বাধা দেয় আহাদ খান গংরা। এ সময় থেকে বাড়তে থাকে তাদের নির্যাতনের মাত্রা। কারণ ইতিপূর্বে আহাদ খান সুখিয়াদের বাড়ির সীমানার ভিতরে মার্কেট নির্মাণ করেন। ওই সময় সুখিয়া ও তার পরিবার বাধা দেন। কিন্তু আহাদ খান সন্ত্রাসীদের দিয়ে হুমকি দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করেন। আহাদ খানের মার্কেটের সামনে মুচি বাড়ি থাকলে মার্কেট চলবে না। তাই তাদের উচ্ছেদে মরিয়া হয়ে উঠেন আহাদ খান।
সুখিয়ার বোন সোমা রবিদাশ জানান, তাদের এখান থেকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করার জন্য আহাদ খান এলাকার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী সাইলুকে লেলিয়ে দেন। এসব অপকর্মে সাইলুর সঙ্গে যুক্ত হয় তার সহযোগী সুজন ও শিপন। এরা অবাদে দিনে রাতে সুখিয়ার পরিবারের ওপর নির্যাতন করতো। সুখিয়ার পরিবারের লোকজন বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে তাদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রথমদিকে নির্যাতনের পরিমাণ কম হলেও দিনদিন তা বাড়তে থাকে। শাইলু ও তার সঙ্গীরা প্রায়ই মাঝ রাতে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করতো। সুখিয়াসহ তার বোনদের ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করতো। তাদের তাণ্ডবে প্রায় রাতেই বাড়ি ছেড়ে বাজারের দোকানের বারান্দায় রাতযাপন করতো সুখিয়ার বোনেরা। সমাজপতিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তারা অভিযোগ করলেও কেউ কর্ণপাত করেনি। মাতলামী ও বিভিন্ন অপরাধে শাইলু জেলে গেলে দায়িত্ব পালন করতো সুজন ও শিপন। শাইলুকে জেল থেকে জামিনে আনতে আহাদ খান ও তার পরিবারের লোকেরা সবসময়ই প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে। মূলত বসতভিটার জন্যই গত ১০ই জুন তৃতীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সুখিয়া রবিদাশ। এর আগে ২০১০ সালে সুখিয়ার স্বামী মনি লাল রবি দাশ হত্যার শিকার হন। ২০০৭ সালে সুখিয়ার ভাই অর্জুন রবি দাশকেও হত্যা করা হয়। এ তিন হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র একই বলে অভিযোগ করেন সুখিয়ার পরিবার ও এলাকাবাসী। আগের দুটি হত্যাকাণ্ডেরই প্রধান আসামি হিসেবে শাইলুকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপরও আহাদ খান ও তার ভাইয়েরা শাইলুকে বাদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে অন্য জেলার লোকদের আসামি দিয়ে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করান।
বর্তমানে সুখিয়া হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আহাদ খান ও তার ভাইদের মামলা থেকে বাদ দিতে এলাকার একদল প্রভাবশালী কাজ করছেন। মামলা তুলে না নেয়ায় সুখিয়ার বাড়িঘরে হামলা করছে দুর্বৃত্তরা। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে সুখিয়ার পরিবার। অন্যতম আসামি শাইলু মিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরও আতঙ্কে দিন যাপন করছে সুখিয়ার পরিবার। হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাদের এখনো পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। তারা বিভিন্নভাবে মামলার বাদী ও তার পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। সুখিয়া হত্যাকাণ্ডের মূলহোতাদের গ্রেপ্তার ও পরিবারের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে হবিগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। সুখিয়ার পরিবারের ওপর নির্যাতন বন্ধে তারা দ্রুত পুলিশি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম জানান, ঘটনার পর পরই আমরা প্রধান আসামি শাইলুকে গ্রেপ্তার করেছি। এর কিছুদিন পর শাইলুর এক সহযোগীকেও আমরা গ্রেপ্তার করেছি। মামলার অন্যান্য আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।
সামাজিক সংগঠন সেক্যুলার বাংলাদেশ মুভমেন্ট ইউকে’র সদস্য সুমন্ত দাস গুপ্ত মানবজমিনকে জানান, সুখিয়া হত্যাকাণ্ডের মামলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আমরা সার্বিক সহায়তা করবো। এছাড়া পরিবারটিকে স্বাবলম্বী করার জন্য তাদের পেশানুযায়ী একটি জুতার দোকান দেয়ার ব্যবস্থা করবো।