ফয়সল আহমেদ তারেক :হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন অমান্য করে বেঙের ছাতার ন্যয় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে ইট ভাটা। ফলে পরিবেশ দূষন ও নানা রকমের হুমকিতে রয়েছে এলাকাবাসী। কৃষি জমি নষ্ট করে, সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে চলছে ইটভাটার কার্যক্রম। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অধিকাংশ মালিক ফসলি জমির ওপরে অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণ করছেন। আর এ সব ভাটা গড়ে উঠেছে ধানের ফসলি জমি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়।
উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ইট তৈরির নামে প্রতি বছর শত শত একর জমির উপরের উর্বর মাটি পুড়ে বিনষ্ট করছে। শুধু উর্বর জমি বিনষ্ট নয়, ইটভাটা থেকে যে দূষিত গ্যাস ও তাপ নির্গত হয় তা আশে-পাশের জীবজন্তু, গাছ-পালা এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং এলাকায় বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্যহানির কারণ ঘটায়। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এমনকি সড়কের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ভাটা স্থাপন সরকারি আইন লঙ্ঘন হলেও অধিকাংশ ভাটার মালিক তা তোয়াক্কা করছেন না। বর্তমানে ইটভাটার জন্য ফল গাছে কোন ফলই ধরে না, বা ধরলেও তা অকালে ঝড়ে পড়ে। এ অবস্থা অভ্যাহত থাকলে এই উপজেলায় কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাবে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ব্যাহত হবে।
ইট ভাটা প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, ইট ভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি (টপ সয়েল) ব্যবহার করলে প্রথম বারের জন্য দুই বছরের কারাদ- ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয় বার ওই একই অপরাধের জন্য ভাটা কর্তৃপক্ষকে ২ থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। অনুমোদন না নিয়ে ইট ভাটা স্থাপন করলে এক বছরের কারদ- এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। আবাসিক জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, বনভূমি, জলাভূমি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এলাকায় ইট ভাটা স্থাপন করলে একই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। ইট ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার করলে তিন বছরের কারাদ- এবং তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তি হতে পারে। এসব আইন সরকারের অফিস আদালতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দেশের সচেতন নাগরিক, কৃষি বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ।
ইট ভাটার কারণে সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাতাস। চুনারুঘাট উপজেলার আশেপাশে রয়েছে ২৫ টির বেশি ইট ভাটা। পরিবেশ থেকে দূষিত বায়ু গ্রহণের ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক এবং ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে হচ্ছে এলাকার মানুষ। আর আমরা নিজের অজান্তেই হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন অসুখ এবং ক্যান্সারের মতো জটিল এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি।
সরজমিন গিয়ে এলাকাবাসী ও সংশিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন সংক্রান্ত কর্মকা- নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্যমান আইন থাকলেও চুনারুঘাট উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটা মালিকরা তা মানছে না। প্রত্যেককে প্রভাবশালী হওয়ায় সরকারি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভাটার কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রশাসনিক তদারকি জোরালো না থাকায় দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন অবৈধ ইটভাটার মালিকরা। অদৃশ্য কারনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এসব ইট ভাটার বিষয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এলাকাবাসীরা বললেন ফসলি জমি গুলোতে এখন আর আগের মত ফসল হয় না। ফলে খাদ্য সংকটে পড়ছেন তারা।
এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়া পরিবেশের ক্ষতি করছে। হুমকির মুখে ফেলেছে শত শত একর ফসলি জমি। এ যেন দেখার কেউ নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাই বার বার বলতে হয়, “সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি”।
ইট ভাটার কারণে চুনারুঘাট উপজেলার মানুষের রোগ-বালাই বেড়ে গেছে। আম ও লিচুর ওজন ও স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ইট ভাটায় বায়ু দূষণ মুক্ত ইট তৈরির প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মাটির ইটের পরিবর্তে বিকল্প ইট তৈরি করতে হবে। এসব প্রযুক্তির ব্যবহার ও গুণাগুণ সব দিক দিয়েই যে উত্তম তা ব্যাপক প্রচার করতে হবে। চুনারুঘাট উপজেলার সকল ইট ভাটা পরিবেশবান্ধব করা হোক এই প্রত্যাশা সকল সচেতন মানুষের।