ডেস্ক : হাহাকারে প্রকম্পিত মিয়ানমার। কেউ মা হারিয়ে দিশাহারা, কেউ বাবা হারিয়ে আবার কেউবা আদরের সন্তানের লাশ দেখে নির্বাক। যখন ছোট্ট শিশু মা-বাবার নিথর দেহ ধরে বলে, ‘আম্মু, আব্বু ওঠো! কথা বলো আম্মু প্লিজ কথা বলো।’ কেমন লাগবে আপনার কাছে তখন? নিজেকে ধিক্কার দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। কী বলব? কীভাবে সান্ত¡না দেব, কিছুই আমার জানা নেই। নিজেকে শুধুই স্বার্থপরই মনে হয়। আজ তাদের জন্য আমরা কিছুই করতে পারছি না। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফের রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন শুরু হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, পুলিশ এবং মগ দস্যুরা একাট্টা হয়ে এই নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ও রাতে ২৪টি নিরাপত্তা চেকপোস্টে হামলার যে ঘটনা ঘটে তারই অজুহাতে নিরীহ-নিরপরাধ রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে চলছে অকথ্য নির্যাতন, গুম, ধর্ষণ ও গ্রেফতার। প্রাণভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ও পলায়নপর রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করতে কিংবা তাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাতেও ঘাতক-জালেমরা দ্বিধা করছে না। খবর পাওয়া গেছে, এ যাবত শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। তাদেরই একাংশ, যাদের সংখ্যা ৫০ হাজারের অধিক, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে জড়ো হয়েছে। পাহাড়-জঙ্গল-নদী ও বাড়িঘরে আটকে আছে আরো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান। গত ১১ আগস্ট হঠাৎই রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রবেশ করে। তখনই আশঙ্কা করা হয়, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর আরেকটি জুলুম-নির্যাতনের তান্ডব আসন্ন। সেনা ও পুলিশ সদস্যরা গ্রামগুলো অবরুদ্ধ করে টহল শুরু করে। এতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান খাদ্য-পানিসহ নানরকম সঙ্কটে পতিত হয়। তারপরই ওই নিরাপত্তা চেকপোস্টে হামলার ঘটনা ঘটে। আর তাকে উসিলা করেই শুরু হয়েছে গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন। ঘটনা প্রবাহ থেকে সহজেই প্রতীয়মাণ হয়, এই গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন পূর্ব পরিকল্পিত। কথিত হামলার ঘটনা তাকে দ্রুতায়িত করেছে মাত্র। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ৯ অক্টোবর এ রকমই একটি হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, পুলিশ ও মগ দস্যুরা ব্যাপক গণহত্যা চালায়। শত শত রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত হয়। নিপীড়ন-নির্যাতন লুণ্ঠন, ধর্ষণ সীমা ছাড়িয়ে যায়। হাজার হাজার অসহায়-নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এবারও সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
গেল বছরের গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণ বিতাড়নের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। জাতিসংঘ ছাড়াও বিভিন্ন দেশ এর প্রতিবাদ জানায়। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে হত্যা-নির্যাতন বন্ধ করতে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে বিশ্বজনমত একই সমতলে এসে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন ঘটিত হয়। ক’দিন আগে কমিশন তার রিপোর্ট ও সুপারিশ পেশ করেছে। ওই রিপোর্টে রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে ৮৮টি সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কমিশনের এই রিপোর্ট ও সুপারিশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যখন ইতিবাচক একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগ্রত করে, ঠিক সেই সময়ে নতুন করে রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতনের আরেকটি অধ্যায় সূচিত হয়েছে। এর শেষ কীভাবে, কোথায় গিয়ে হবে-তা এখনই বলার উপায় নেই। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতনের কথা কখনই স্বীকার করে না। গত বছরের ঘটনা তদন্তে সরকারিভাবে গঠিত কমিটির রিপোর্টে নির্লজ্জভাবে দাবি করা হয়েছে, কোনো হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। বড়ই পরিতাপের বিষয়, গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী বলে পরিচিত অং সান সূচি নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের হত্যা-নির্যাতন ও বর্বরতার প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, ‘আমি নিরাপত্তাবাহিনীর ও পুলিশ সদস্যদের প্রশংসা করতে চাই যারা অসীম সাহসের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন।’ আশঙ্কা করা হচ্ছে, অং সান সূচির এই মনোভাবের প্রেক্ষাপটে চলমান পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে।
রাখাইনে রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ে যায়। অসহায়-নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশের দিকেই ছুটে আসে। এভাবে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। গত বছর এসেছে প্রায় এক লাখ। মানবিক কারণেই বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। এবারো ইতোমধ্যে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা মুসলমান প্রবেশ করেছে। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ দু’জনের একজন হাসপাতালে মারা গেছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ‘বাঙালি’ বলে প্রচার করে, যদিও তারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করছে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকের মতো তারাও সেখানকার ভূমিপুত্র। বাঙালি বলে অভিহিত করে মিয়ানমার তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চায়। বাংলাদেশ এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবারো প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই সঙ্গে মিয়ানমারের ঘটমান পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রোহিঙ্গা-অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকার নিলেও তাদের আসা পুরোপুরি রোধ করা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এই গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছে। সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। বলা বাহুল্য, শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করলে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা, নৃশংসতা ও বর্বরতার অবসান হবে না। এজন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। গোটা একটি জাতিগোষ্ঠী নির্মূল করে দেওয়া হবে, এটা হতে পারে না। এ কথা সবারই জানা, রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। চীন এক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা আশা করতে চাই, হত্যা-নির্যাতন-বিতাড়নের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ প্রতিরোধে চীন কার্যকর উদ্যোগ নেবে। এ মুহূর্ত গণহত্যা বন্ধ করা জরুরি। বাংলাদেশ-চীনসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়ক একযোগে সোচ্চার হয়ে বলতে হবে- গণহত্যা বন্ধ করা হোক। বন্ধ করা হোক গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন। পরিশেষে এটাই বলব, তারাও তো আমাদের ভাই। এক দেহের একই প্রাণ। এক অঙ্গে ব্যথা পেলে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি মিয়ানমারের ভাই-বোনদের ব্যথায় আমাদের ব্যথিত হওয়া উচিত। তবে সে ব্যথা শুধুই মুখে প্রকাশ নয়, কঠোর আন্দোলন দিয়ে তা প্রকাশ করতে হবে। প্রয়োজনে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দাঁড়াতে হবে তাদের পাশে।