রায়হান আহমেদ : দুনিয়া বড়ই নিষ্ঠুর। এখানে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সবাই অকৃপণ। স্বার্থের পর্যায়টি সম্পূর্ণ করতে অমানবিক কর্মটি করতেও কেউ দ্বিধাবোধ করে না। সব জায়গায়, সব সময়, ধর্মে-বর্ণে-কর্মে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের ঘাড়ে চেঁপে বসে রক্ত চুষার চক্র বাঁধে। ঠিক রূপকথার রাক্ষস-খোক্ষসের মতো। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, ‘পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার লীলা নিকটে আসবে, যখন অযোগ্য কেউ রাষ্ট্রের প্রধান হবে। যখন মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ, মূল্যবোধ, সৌজন্যবোধ বিলুপ্তের পথে হাঁটবে।’
বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি তো আয়নার প্রতিচ্ছবির মতোই ধ্বংস লীলার স্বরূপ। মানবতা কতো নিচে নামলে নির্বিচারে নির্দোষ মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করা যায়? কতটুকু অশ্রু বিসর্জন করলে হারানোর বেদনা ভুলে থাকা যায়? তা এখন কেবলই বলতে পারবে একটি জাতি। বর্তমান সময়ের সবচে’ নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। হ্যাঁ, আমি রোহিঙ্গাদের কথা বলছি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যাজ্ঞের কথাই বলছি। মিয়ানমার সরকার মিয়ানমারের ভূমি থেকে রোহিঙ্গাদের বিতারিত করার জন্যই মূলত এ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এদিকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো সরকারের দাবী, রোহিঙ্গারদের মিয়ানমারে রাখা যাবে না। রোহিঙ্গারা বাঙালি। এ দাবী মনে করিয়ে দিচ্ছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি কথাকে। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমার আপেক্ষিকবাদ সঠিক হয়, তাহলে ফ্রান্স বলবে আমি বিশ্ব নাগরিক, আর জার্মান দাবী করবে আমি জার্মানি। যদি এটি ভূল প্রমাণিত হয়, তাহলে ফ্রান্সরা বলবে আমি জার্মান, আর জার্মানিরা বলবে আমি ইহুদি। পরে আমাকে হত্যা করা হবে।’
রোহিঙ্গারা হলো মিয়ানমারের রাখাইন ষ্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে এ জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে এই জাতির উদ্ভব। তবে তো মিয়ানমার সরকারের দাবী আইনস্টাইনের কথার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা যদি জাতি হিসেবে সম্মৃদ্ধশালী হতো, তবে সরকার তাদের নিয়ে গর্বে বুক ফুলাতো। তাদের মাথায় তুলে রাখতো। রোহিঙ্গাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কারণ হিসেবে আরেকটি যুক্তি দাঁড় করিয়েছে সরকার। রোহিঙ্গাদের মধ্যে নাকি জঙ্গি তৎপরতা। তাহলেই কী জঙ্গি অপরাধে পুরো জাতি শাস্তি পাবে! এ অপরাধের জন্য একটি জাতি নিধন প্রক্রিয়াকে মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ কখনো সমর্থন করবে না। তবে কী মিয়ানমার সরকারের মানবতা অনুপস্থিত! আসলে কাউকে ধ্বংস করতে হলে সামান্য একটা ইস্যু দাঁড় করানোই যথেষ্ট। রোহিঙ্গা নিধনের রূপরেখো অনেক আগে থেকেই অঙ্কিত ছিল। ধীরে ধীরে এর চরম প্রতিফলন এখন রোহিঙ্গাদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। প্রথমে সরকার রোহিঙ্গাদের সর্বপ্রকার মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েও খান্ত হয় নি। এখন তাদের উপর পৈশাচিক আচরণ করছে। গানের কথায়, ‘চোখ যে মনের কথা বলে।’ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক দৃশ্যগুলো হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মতো দৃশ্য। আজ নির্যাতনের ছবিগুলো যেন অমানবিকতার কথা বলছে। এ বর্বরতার বিষয়ে জাতিসংঘ যা বলছে, তা যেন দায় সারার কথা। কিন্তু কেন! বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত খুলে দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা গণহারে এদেশে প্রবেশ করছে। এভাবে যদি চলতে থাকে, তবে আমরা কি কোনো সংকটে পড়বো না! রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কি দায়-দায়িত্ব সব আমাদেরই! নির্যাতন করা সহজ ব্যাপার। কিন্তু নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রমে অংশ নেয়া বড়ই কঠিন। এ সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের অগ্রনী ভূমিকা নেয়া উচিৎ। বাংলাদেশ সরকারের অনতিবিলম্বে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এদেশে রোহিঙ্গা শরণার্তীদের মিয়ানমার সরকার শীঘ্রই ফেরত নিতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। নয়তো উদরতার চিত্রটা পরবর্তীতে ভিন্নরূপ নিতে পারে। অন্যরূপ নিলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আফসোস করতেও হতে পারে। এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য সাম্প্রদায়িকতা ভুলে সকল দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। রুখতে হবে এ অপ্রত্যাশিত বর্বরতাকে। তবেই উজ্জ্বল হবে মানবতার দৃষ্টান্ত।