আগাম বন্যায় কৃষকের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। মেঘে ঢাকা কালো আকাশ আর মেঘের গর্জন শুনে কৃষকের মন এখন আঁতকে উঠে….
কাজল সরকার, হবিগঞ্জ : এখনও চৈত্র ফেরোইনি। সবেমাত্র বৈশাখ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যে বৈশাখকে ঘিরে সোনালী স্বপ্নে বিভোর থাকেন কৃষকরা। যে মাসকে বলা হয় কৃষকের স্বপ্নের মাস, সাধনার মাস। সে বৈশাখ যেন কৃষকের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে চলেছে।
গেল দুই বছর কৃষকরা সারা বছরের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। আগাম বন্যায় বিস্তৃর্ণ হাওরের আধা পাকা ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এখনও সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি হাওরের কৃষকরা। এর মধ্যে এ বছর দেখা দিয়েছে আরও বড় বিপত্তি।
অতি আগাম বন্যা যেন কৃষককে বুক দাপিয়ে ডাকছে। মেঘে ঢাকা কালো আকাশ আর মেঘের গর্জন শুনে কৃষকের মন এখন আঁতকে উঠে।
ইতোমধ্যে হাওর এলাকার নিচু জমিগুলো ডুবতে শুরু করেছে। কৃষকদের তথ্য মতে বানিয়াচং, নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার প্রায় কয়েকশ’ একর জমির কাচাঁ ও আধাপাঁকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। আর কয়েক হাজার একর জমির ধান তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। গলা পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেগুলোও তলিয়ে যাবে।
এদিকে, প্রতিদিন যেন ত্রি-রূপে সেজেছে ধরা। মেঘ-বৃষ্টি আর ঝড়ের খেলা চলছে দিন-রাত। যে রূপ ফলছে আকাশে, তা হৃদয়পটেও নাড়া দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত অস্থিরতায় ভরে উঠছে কৃষকের মন। আহার-নিদ্রাবিহিন কৃষক আকাঙ্খিত দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছেন হাওরের পানে।
জেলার বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে পানি উঠতে শুরু করেছে। আবার কোথাও কোথাও ছোট ছোট বাধগুলোতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ধানী জমির হাওরে পানি ডুকছে। ইতোমধ্যে নিচুঁ এলাকার জমিগুলোর কাচাঁ ও আধা পাকা ধান তলিয়ে গেছে।
কৃষকদের তথ্যমতে জেলার তিন উপজেলায় প্রায় কয়েকশ’ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এতে করে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন অনেক কৃষক। অল্প জমি চাষ করা কয়েকজন কৃষক ইতোমধ্যে পথে বসেছেন বলেও দাবি করছেন অনেকে।
কৃষকরা বলছেন- গত কয়েকদিন বৃষ্টিতে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আর এসব নদ-নদীর পানি বিভিন্ন খাল বিলের মাধ্যমে হাওরে প্রবেশ করছে। এছাড়া বৃষ্টির পানিও হাওরে জমা হচ্ছে। ফলে হাওরের নিচুঁ জমিগুলো ডুবতে চলেছে। তবে ইতোমধ্যে অনেকগুলো জমি ডুবেও গেছে।
তাঁরা বলছেন- অনান্য বছর বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে এসে বন্যা দেখা দেয়। এ সময় জমির ধানগুলো অধিকাংশই পেকেঁ যায়। ফলে পানিতে ডুবে যাওয়া কিছু ধান কেটে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু এ বছর যে জমিগুলো পানিতে ডুবে গেছে সেগুলো সম্পূর্ণ কাচাঁ। ফলে কাটার কোন উপায় নেই। এছাড়া কয়েক হাজার জমির ধান এখন পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে।
এদিকে, উচুঁ জমির ধান নিয়েও দুশ্চিন্তায় দিন-রাত কাটছে কৃষকের। প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে কাচাঁ ধানই পানিতে তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
এ ব্যাপারে বানিয়াচং উপজেলার হারুনী গ্রামের কৃষক সুদাংশু দাস বলেন- ‘আমার অনেক জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম।’
তিনি বলেন- ‘গত দুই বছর চাষ করেও কোন ধান ঘরে তুলতে পারিনি। এ বছরও যদি একই অবস্থা হয় তাহলে আমাদের না খেয়ে মরা ছাড়া কিছু করার নাই।’
একই এলাকার কৃষক দ্বিজেন্দ্র দাস বলেন- ‘গত দুই বছরের ঋণই এখনও পরিশোদ করতে পারিনি। এ বছর আবার একই বিপত্তি। আমরা হাওরের মানুষদের মরা ছাড়া আর কোন উপায় না।’
তিনি বলেন- ‘এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিদিন পানি বেড়ে চলেছে। উচুঁ জমির ধানগুলো তুলতে পারব তারও কোন ভরসা পাচ্ছি না।’
আজমিরীগঞ্জ উপজেলা সদরের বাসিন্ধা মোতাহের মিয়া বলেন- ‘অন্য বছর বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে বন্যার দেখা দেয়। এতেও সব ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এ বছর চৈত্র মাসেই যেখানে অনেক ধান তলিয়ে গেছে সেখানে ধান ঘরে তুলার স্বপ্নতো স্বপ্নই থাকবে।’
তিনি বলেন- ‘এখন চৈত্রর খড়ায় ঘর থেকে বেড় হওয়া দায় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ বছর বৃষ্টির কারণে বেড় হওয়া যাচ্ছে না। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।’
যদিও বিষয়টি অনেকটা এড়িয়ে গেলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন- ‘গতকালও আমরা বানিয়াচং উপজেলার বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করে এসেছি। আমাদের কাছে এমন কোন তথ্য নেই। তাছাড়া উপজেলা অফিসসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।’
এ বক্তব্যের ঘন্টাখানেক পর তিনি আবার মোবাইল ফোন করে জানান- সামান্য কিছু জমি তলিয়েছে। তবে সেগুলো একদম নিচুঁ এলাকার জমি।
তাছাড়া কোন বাঁধ ভাঙেনি। কয়েকটি নদী পাড়াপারের রাস্তা ভেঙেছে। তবে এতে হাওরের ধানের কোন ক্ষতি হবে না।’