যদি এখন স্থানীয় সরকার থেকে দলীয় প্রতীক বাদ না দেওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতে যখন দলের বিভিন্ন কমিটি হবে, তখন নেতারা দলের উন্নতি চিন্তা না করে যোগ্য লোককে পদ না দিয়ে নিজের আজ্ঞাবহ এবং ঘনিষ্ঠদের দিয়ে পদ পূরণ করবেন। এতে করে দুর্বল হবে দল। রাজনীতির গুণগত মান আরও কমবে।
শাহ ফখরুজ্জামান : দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের ধারণা আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা। বেশি দিন হয়নি এই চর্চা। এরমধ্যেই রেকর্ড খারাপ এ পদ্ধতির। এখন পর্যন্ত এই চর্চা আমাদের সুখকর কোনো অনুভূতি দেয়নি। বরং রাজনীতির আদর্শহীনতা, কোটারি স্বার্থ আর ইজমের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে চরমভাবে। এক ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে রাজনীতিকে। অবজ্ঞা আর অবহেলার মুখে ফেলে দিয়েছে রাজনীতিবিদদের নীতি-আদর্শকে। এমনকি বাড়িয়ে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও।
বাংলাদেশের স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার নতুন হলেও বহু দেশে এই সংস্কৃতি পুরোনো। ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে। পশ্চিমবঙ্গে পুর নির্বাচন হয়েছে স্ব স্ব দলের প্রতীকে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা সর্বদা রাজনীতি-বিযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চেয়েছে ও চায়।
আমাদের গণতান্ত্রিক দীক্ষা ও উত্তরাধিকার যেখান থেকে পেয়েছি, সেই যুক্তরাজ্যেও কিন্তু দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচন হয়। প্রতিবেশী ভারতেও দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হওয়ার সংস্কৃতি বিদ্যমান। এ প্রেক্ষাপটেই হয়তা বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক চালু হয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে এখনও এটি মেনে নেওয়ার মতো প্রস্তুতি নেই, তা বিগত কয়েকটি নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা এই ধারায় অভ্যস্থ নই এবং চর্চা করারও আগ্রহ নেই। তাই বর্তমানে এটি পরিবর্তনের কথাও চলছে।
রাজনীতি নিয়ে সুযোগ পেলেই এক শ্রেণির মানুষ নেতিবাচক কথা বলে। কিন্তু রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের মধ্যেই একটি দেশ এবং সমাজের পরিবর্তন নির্ভরশীল। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলে যে টার্মটি ব্যবহার করা হয়, সেটিও একটি নেতিবাচক ধারণা থেকে। এ কথার মানে একজন রাজনীতিবিদ তার সিদ্ধান্ত এবং নীতি আদর্শ যেকোনো সময় পরিবর্তন করতে পারেন। যারা সারাজীবন শুদ্ধ রাজনীতি চর্চা করেন, তাদের কাছে রাজনীতি নিয়ে এ ধরনের অবহেলা পীড়াদায়ক। অথচ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেওয়ার পর রাজনীতিবিদদের নীতি-আদর্শ আরও বড় ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
রাজনীতিতে যারাই নেতা হন, তারা চেষ্টা করেন ইজম তৈরি করার জন্য। যোগ্য ও ত্যাগী লোককে স্থান না দিয়ে নিজের আস্থাভাজন লোকজনকে বড় বড় পদে আনেন। শুধু তা-ই নয়, নিজের আত্মীয়-স্বজনকেও নিয়ে আসেন সামনে। এতে যারা শুদ্ধ রাজনীতি চর্চা করেন, তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেওয়ার পর মনোনয়ন পেতে তৃণমূলের নেতার সমর্থন প্রয়োজন হয়। ফলে এখন সেই পদে নিজের লোক বসানোর কাজ চলে। আবার যারা দলীয় প্রতীক পান না, তারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তাদেরও কেন্দ্র এজেন্ট এবং কর্মীর জন্য তারা যে ইউনিটের নেতা, সেই ইউনিটে নিজের আস্থাভাজন লোককে বসাবেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই একজন নেতার সৃষ্টি হয়। একসময় ছাত্রনেতারা অনেক ত্যাগ এবং সাধনার মাধ্যমে কর্মী সৃষ্টি করতেন। তারা এই কর্মীদের দলের নীতি ও আদর্শের প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় নেতা হিসেবে গড়ে তুলতেন। পরবর্তীকালে এখান থেকেই হতেন জনপ্রতিনিধি।
কিন্তু এই ধারার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর কেউ আদর্শ দেখে এবং নেতাদের মমতাময় আহবানে সাড়া দিয়ে দল করতে আসেন না। এখন যারা দল করতে আসেন, তাদের কাছে ব্যক্তিগত ফায়দা গুরুত্বপূর্ণ। গোষ্ঠী অথবা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই অনেকে এখন রাজনীতিতে আসেন। ফলে রাজনীতির ভিত্তি দিনে দিনে আরও দুর্বল হচ্ছে।
যে যে দলই করুক না কেন রাজনীতি একটি নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই করতে হয়। এই নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে অবশ্যই করণীয় বিষয় দলের সিদ্ধান্ত মেনে চলা। দলীয় প্রতীককে সম্মান দেখানো এবং সেই প্রতীকে ভোট দেওয়া এবং ভোট চাওয়া। পাশাপাশি দলের নেতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য থাকা। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক আসার পর দেখা গেলো নেতাকর্মীরা আর কেউই এই ধারার মধ্যে নেই।
যেকোনো নির্বাচনে একজন নেতা দলীয় মনোনয়ন পান। এক্ষেত্রে ওই নেতাকে যারা পছন্দ করেন না, অথবা তাকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হানীর আশঙ্কা থাকে, তখন তারা আর দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নেতার পাশে থাকেন না। অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। অনেকেই আবার দলীয় প্রার্থীকে ফেল করানোর জন্য প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীকে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে সমর্থন করেন। এছাড়াও অনেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে হয়ে যান স্বতন্ত্র প্রার্থী।
ওই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আবার থাকেন রাজনৈতিক দলের কোনো ইউনিট বা সহযোগী সংগঠনের প্রধান নেতা। তখন ওই বিদ্রোহী প্রার্থীরা তারা যে ইউনিট বা সহযোগী সংগঠনের নেতা, সেখানের নেতাকর্মীদের বাধ্য করেন দলীয় প্রার্থী ছেড়ে তার পক্ষে কাজ করার জন্য। নেতাকর্মীরাও থাকেন মানসিকভাবে দুর্বল। কারণ নেতাকে অনেক অনুনয় করে পদ পেয়েছিলেন তারা! শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে আরও বড় পদ পেতে হলে ওই নেতার আর্শীবাদই প্রয়োজন। তাই দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তে দলীয় প্রতীক বাদ দিয়ে ইউনিটের নেতাকে তোষণে ব্যস্থ থাকেন তারা।
এতে রাজনীতির গুণগত মান কতটা নিচে নামছে, তা কী কেউ ভেবে দেখেছেন। এই পদ্ধতিতে দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। আবার নেতাকর্মীরা যে দল এবং আদর্শ দেখে রাজনীতিতে আসেন না, তারও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ এটা। একইসঙ্গে দলীয় প্রতীকের বিরুদ্ধে যাওয়া নেতাকর্মীরা যখন রাজপথে ভোট চান, তখন সাধারণ মানুষ মনে মনে হাসেন। রাজনৈতিক নেতা এবং দলকে তারা খাটো করে দেখার সুযোগ পান।
যদি এখন স্থানীয় সরকার থেকে দলীয় প্রতীক বাদ না দেওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতে যখন দলের বিভিন্ন কমিটি হবে, তখন নেতারা দলের উন্নতি চিন্তা না করে যোগ্য লোককে পদ না দিয়ে নিজের আজ্ঞাবহ এবং ঘনিষ্ঠদের দিয়ে পদ পূরণ করবেন। এতে করে দুর্বল হবে দল। রাজনীতির গুণগত মান আরও কমবে। পাশাপাশি নব্য ঔপনিবেশিকদের স্বার্থ উদ্ধার হবে। তাই এখনই সময় এ ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার। না হলে দেশের রাজনীতি দেউলিয়াপনা হয়ে যাবে।
লেখক- শাহ ফখরুজ্জামান
সাংবাদিক ও আইনজীবী
তারিখ : ২৪/০৮/২০২০