উঠতি বয়সের ছেলেরাই মাদক সেবনে ঝুঁকছে বেশি
রায়হান আহমেদ : ভারতীয় সীমান্ত এলাকা হওয়ায় চুনারুঘাট উপজেলায় নিয়ত ঢুকছে ভারতীয় মাদক। মাদক ব্যবসায়ীরা এসব মাদক উপজেলার এক স্পট থেকে অন্য স্পটে ছড়িয়ে দেয়। পরে বিভিন্ন পন্থায় হবিগঞ্জ জেলায় ও সারাদেশে পাচার হয় এসব নিষিদ্ধ মাদক। যা সেবনের কারণে দিনকে দিন ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এ মাদক সেবনে বেশি ঝুঁকছে উঠতি বয়সের ছেলেরা। ফলে নষ্ট হচ্ছে তাদের সোনালী ভবিষ্যত।
মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। নেশা করার জন্য টাকা না পেলে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, খুন সহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বলা যায়- এ সময়ে মাদক এক প্রকার সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে মাদক সেবনকারীরা নিজের জীবনকে বিনষ্ট করে, অপরদিকে তার সাথে জড়িত সবাইকে অতিষ্ট করে তুলে। একজন মাদকসেবী স্বামী মাতাল হয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন করে, যৌতুকের জন্য চাপ দেয়, বাড়তি সম্পত্তির জন্য আপন ভাইয়ের সাথে মারামারিতে লিপ্ত হয়, ধর্ষণের মতো জঘণ্য কাজও তার কাছে ভালো মনে হয়। তারা মা-বাবার অবাধ্য হয়, এমনকি নেশায় বশীভূত হয়ে নিজ মা-বাবাকে খুনও করে।
মাদক ব্যবসায়ীকে এ ব্যবসায় বাধা দিলে তারা হিংস্র হয়ে উঠে। ফলে তারা মানুষ খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এসব চিত্র এখন চুনারুঘাটে হারহামেশাই দেখা যাচ্ছে। বিগত ২১মে রাতে উপজেলার আহম্মাদাবাদ ইউপি’র বগাডুবি গ্রামে মাদক ব্যবসায়ীর ছুরিকাঘাতে রাব্বি নামের এক কিশোর প্রাণ হারায়। মাদক ব্যবসা করে রাতারাতি অনেকেই প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক বনে গেছে। অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় সমাজের ভালো মানুষের মুখোশ পড়া বহু লোক এ অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকসহ ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করছেন। কিন্তু চুনারুঘাটের সীমান্ত দিয়ে প্রচুর পরিমাণ মাদক আসার ফলে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।
মাদকের আধিক্যতা কমাতে হলে প্রথমেই সীমান্ত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োগ করা জরুরী। মাদক থেকে দূরে থাকতে প্রত্যেক পরিবারের উচিৎ তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় গাইডলাইন দেয়া। তাছাড়াও মাদক বিরোধী সভা-সমাবেশ করা যেতে পারে। নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি বহাল রাখলে এ মরণনাশক দ্রব্য থেকে চুনারুঘাটের যুব সমাজ রক্ষা পাবে।
চুনারুঘাট উপজেলায় রয়েছে ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত। প্রায় পুরো উপজেলা জুড়ে রয়েছে বন-বাদাড়। সেই সীমান্ত সুরক্ষায় স্থানে স্থানে স্থাপিত হয়েছে সীমান্তরক্ষীর চৌকি। সাতছড়ি, চিমটিবিল, গুইবিল, বাল্লা, রেমা ও কালেঙ্গা সীমান্ত চৌকিগুলোতে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) নিয়োজিত আছে। ২০০৫ সালে ভারতে সরকার সীমান্ত সন্ত্রাস, উগ্রপন্থি সংগঠন ও চোরাচালান রোধে পুরো সীমান্ত জুড়ে কাঁটা তাঁরের বেড়া নির্মাণ সম্পন্ন করে, তবে চড়া দিয়ে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ছড়ার উপর দিয়ে বেড়া নির্মান করে-ফলে বেড়ার নীচ ফাঁকা থেকে যায়। সেই ফাঁক দিয়েই অবাধে চলছে চোরাচালান। ভারতে মাদক সহজলভ্য হওয়ায় মাদকটাই বেশী আসছে দেশে।
অনুসন্ধানে জানা যায়- রেমা সীমান্তের আলীনগর, রেমা, বাল্লা সীমান্তের মোকামঘাট, পাক্কাবাড়ি, টেকেরঘাট, বড়ক্ষের, দুধপাতিল, গুইবিল সীমান্তের নালুয়া, ডুলনা, ইকরতলী, সাদ্দামবাজার, হাপ্টারহাওর, চিমটিবিল সীমান্তের চিমটিবিল খাস ও সাতছড়ি সীমান্তের ২শ’ শতাধিক চোরাকারবারী এখন মাদক ব্যবসায় জড়িত। এছাড়া চুনারুঘাট সদর, নোয়ানী, সাড়েরকোনা, ময়নাবাদ, দেওরগাছ, পাকুরিয়া, সাটিয়াজুড়ি, রানীগাও, মহদিরকোনা, বনগাঁও, সুন্দরপুর, গোবরখলা, চেকানগর, ফাটাবিল, দিঘিরপাড়, বিলপাড়সহ প্রায় ৫০টি গ্রামের বেশ কিছু লোক মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। ফলে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।
করোনা ভাইরাস আসার আগে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। এ সময় বেশ কিছু মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ে। কিন্তু মাদকের গডফাদাররা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। করোনার লকডাউনের সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা দেদারচে মাদক পাচার করছে। পাচারে বাধা দিলে জীবন হুমকীর মুখেও পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
জানা যায়- সীমান্তের আহম্মদাবাদ ও গাজীপুর ইউনিয়ন মাদক পাচারের নিরাপদ রোডে পরিণত হয়েছে। চিমটিবিল, আমু চা-বাগান সড়ক, আমু চা বাগান-আমুরোড বাজার সড়ক, আমুরোড বাজার-বনগাঁও বাঁশের তলা সড়ক, আমুরোড বাজার, শুকদেবপুর সড়ক, আমু চা-বাগান, কালিশিরি সড়ক, কালিশিরি-দেওরগাছ সড়ক, গাজীপুর ইউনিয়নের দুধপাতিল-আসামপাড়া বাজার সড়ক, আসামপাড়া-চুনারুঘাট সড়ক, রেমা চা-বাগান, সুনাচং বাজার সড়কসহ সীমান্তের সবক’টি সড়ক দিয়ে মাদক পাচার হচ্ছে অবাধে। আরো জানা যায়- মাদক পাচারের জন্য মোটরসাইকেল, টমটম, মোটরচালিত রিক্সা, নাভানা, প্রাইভেট কার এবং বাইসাইকেল ব্যবহৃত হয়। মাদক পাচারকে নিরাপদ রাখার জন্য কতিপয় ব্যক্তিকে দেয়া হয় বখরা।
বিজিবি’র ৫৫-ব্যাটালিয়ানের সিও লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সামীউন্নবী চৌধুরী জানান- ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে মাদক নির্মূল করতে হলে এলাকার মানুষের সহযোগীতা প্রয়োজন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো- কিছুদিন আগে আমরা যখন মাদকের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান পরিচালনা করি, তখন কতিপয় মাদক ব্যবসায়িদের সাথে নিয়ে চুনারুঘাটের সুশীল সমাজের একাংশ আমাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন। এসব করলে আমরা কিভাবে মাদক নির্মূল করবো! তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সীমান্ত দিয়ে যেন মাদক না ঢুকে।’
হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার এস এম মুরাদ আলী জানান- ‘হবিগঞ্জকে মাদকমুক্ত করতে আমরা ইতোমধ্যে বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রত্যেক থানার ওসিকে সে মোতাবেক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই- যে অঞ্চলে মাদক বেশি, সে অঞ্চলে অপরাধও বেশি সংগঠিত হয়। তাই চুনারুঘাটকে মাদকমুক্ত করতে ওসিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা সে লক্ষে কাজ করছি।’
র্যাব-৯ এর এএসপি (মিডিয়া) সুমেন জানান- ‘মাদক নির্মূলের লক্ষ্যে আমরা প্রতি মাসেই বিপুল পরিমাণ গাঁজা চুনারুঘাট থেকে উদ্ধার করছি। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
চুনারুঘাট থানার ওসি আলী আশরাফ জানান- ‘চুনারুঘাট থানা এলাকাকে মাদক নির্মূল করতে আমরা বদ্ধ পরিকর। আগের চেয়েও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান বেশি সংঘটিত হচ্ছে। ফলে আমরা নিয়ত মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করছি। আশা করি, অচিরেই মাদকমুক্ত চুনারুঘাট উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।’