বাহুবল প্রতিনিধি : বাহুবল বাজারের পিঠা বিক্রেতা কিশোর নিজাম আবার ফিরছে কোলাহলপূর্ণ স্কুল ক্যাম্পাসে। পিঠার থালার পরিবর্তে হাতে উঠছে তার বই, খাতা, কলম। মাত্র ৫০ টাকা মজুরীর জন্য এ কিশোর দীর্ঘদিন ধরে অফিসপাড়া ও বাজারে পিঠা বিক্রি করে আসছে। তার ও তার পরিবারের দূর্দশার চিত্রটির প্রতিবেদন স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে তোলে ধরেন দৈনিক প্রথম ভোরের বাহুবল প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম শামিম। নজরকাড়ে সুহৃদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জসীম উদ্দিনের।
তিনি ওই কিশোর ও তার ছোট দু’ভাইকে বিদ্যালয়ে পূনঃভর্তি এবং স্বামী পরিত্যাক্তা মা-বোন ও প্রতিবন্ধী বোনের পূনর্বাসনের দায়িত্ব নেন। আলোচিত পিঠা বিক্রেতা নিজাম উদ্দিন উপজেলা সদর সংলগ্ন পুরান মৌড়ি গ্রামের দিনমজুর রিয়াজ উদ্দিনের পুত্র।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর ফিরোজা খাতুন কাজ করতেন বাহুবল ও শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন ফলের বাগানে। অনুমান ৩০ বছর আগে তিনি শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর এলাকার রিয়াজ উদ্দিনের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী-স্ত্রী বাগানে মজুর হিসেবে কাজের খুজে আসেন বাহুবল উপজেলার পাহাড়ি এলাকায়। তথায় দীর্ঘদিন এ দম্পতি কাজ করার সুবিধার্থে বসবাস শুরু করেন পুরান মৌড়ি গ্রামের খলিল মিয়ার বাগানে। তথায় এ দম্পতি পাহাড়াদার ও মজুরের দায়িত্ব বিশ্বস্থতার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। এ দীর্ঘ সময়ে এ দম্পত্তির সংসারে জন্ম হয় ২ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তানের। ১ম কন্যা রুমানা খাতুন ও ২য় কন্যা প্রতিবন্ধী নাজমিন খাতুন। ৩য় থেকে ৫ম সন্তান যথাক্রমে নিজাম উদ্দিন, মোজাম্মেল ও মুজিব মিয়া।
রুমানা খাতুনকে বিয়ে দেয়া হলেও স্বামী পরিত্যাক্তা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পিতা-মাতার অন্নেই তার শেষ ঠিকানা হয়েছে। আরেক মেয়ে নাজমিন খাতুন প্রতিবন্ধী হিসেবে ফিরোজা-রিয়াজ দম্পতির ঘাড়ে তো বোঝা হয়ে আছেই। এ অবস্থায় এ দম্পতির আয়ে সাত সন্তানের পরিবারের চাকা ঘুরছেই না। অসহায় রিয়াজ উদ্দিন সংসারের অভাব দূর করার চিন্তায় উদগ্রীব হয়ে উঠেন। শত চেষ্টায়ও তিনি সুদিনের সন্ধান পাচ্ছিলেন না। ক্রমেই তার পৃথিবী ছোট হতে থাকে। হতাশ হয়ে পড়েন রিয়াজ উদ্দিন। তাকে পেয়ে বসে পাহাড়সম দুশ্চিন্তা। এক সময় তিনি হয়ে উঠেন প্রায় উন্মাদ। স্ত্রী, সন্তানদের ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান দিনমজুর রিয়াজ উদ্দিন।
কিন্তু সন্তানের মায়ার জাল ছিড়ে বের হতে পারেননি মমতাময়ী মা ফিরোজা খাতুন। তিনি একার আয় দিয়েই টানতে থাকেন সংসার নামের রেলগাড়িটিকে। এক পর্যায়ে বড় ছেলে নিজাম উদ্দিনকে স্কুলে পড়ানো বাদ দিয়ে কাজের খোজে পাঠান। সেই নিজাম উদ্দিনই দীর্ঘদিন ধরে বাহুবল ভেতর বাজারের বিভিন্ন ভাসমান রেস্টুরেন্টে তৈরি পিঠা ফেরী করে বিক্রি করে আসছে। এ কাজের মাধ্যমে সে রোজগার করছে ৫০ টাকা। এ টাকা নিজাম উদ্দিন তোলে দিচ্ছে সংগ্রামী মা ফিরোজা খাতুনের হাতে। তা দিয়েই ৬ সদস্যের পরিবার চলে অনাহারে-অর্ধাহারে।
বুধবার সন্ধ্যায় জীবন সংগ্রামী নিজাম উদ্দিন ও তার মা ফিরোজা খাতুনকে প্রতিবেদক মনিরুল ইসলাম শামিমের মাধ্যমে ডেকে আনেন বাহুবল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জসীম উদ্দিন। তিনি তাদের দুর্দশার কাহিনী শুনে মা ফিরোজা খাতুনকে বিজিএফ বা বিজিডি কার্ড এবং প্রতিবন্ধী বোন নাজমিন খাতুনকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনার আশ্বাস দেন। এছাড়া নিজাম উদ্দিন (১২), তার ভাই মোজাম্মেল (৮) ও মুজিব মিয়া (৫) কে স্থানীয় মৌড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ও উপ-বৃত্তি সুবিধা প্রদানের আশ্বাস দেন। এ সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জসীম উদ্দিন নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ শফিউল্লাহ ৩ হাজার টাকা এবং স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শুভ্র দেব অভি ২ হাজার টাকা দরিদ্র এ পরিবারের সদস্যদের হাতে তোলে দেন।