আন্তর্জাতিক: মায়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক মহল। পাশাপাশি মায়ানমারের ওপর বাড়ছে চাপ দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে। মায়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটির তথ্যমতে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদিকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ যে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে, তার স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনে গত বৃহস্পতিবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট মায়ানমারের সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, আমি জানি, অন্য যে কোন দেশের মতোই, শরণার্থীদের ভার বাংলাদেশকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। বার্মার উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গত ২৪ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ চেকপোস্ট ও সেনা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির হামলার পর সেখানে পাল্টা সেনা অভিযানের মুখে প্রতিদিনই রোহিঙ্গা মুসলিম দেশ ছাড়ছেন। ওই হামলার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আর সহিংসতা না চালিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র। রাখাইনে অস্থিরতা বাড়ে এমন কোন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে নোয়ার্ট বলেন, ‘আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে জরুরি মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছার সুযোগ করে দিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের আহ্বান রইল।’
বাংলাদেশ গত কয়েক দশক ধরে মায়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহন করে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে এলেও মায়ানমার তাতে সাড়া দেয়নি। সর্বশেষ সপ্তাহ দুয়েক আগে হামলার ঘটনার পর গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে জাতিসংঘের ধারণা। এদিকে দমন অভিযানের মুখে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা দূরে থাক তারা যে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে সে বিষয়ে মোটেই মুখ খুলছেন না মায়ানমারের নেতা অং সান সুচি। উপরন্তু রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ‘সন্ত্রাসীরা’ প্রচুর অসত্য তথ্য ও ভুয়া ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে তিনি দাবি করেছেন। এ কারণে পশ্চিমা বিশ্বে তার কড়া সমালোচনা হচ্ছে; এমনকি শান্তির জন্য পাওয়া তার নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়ার দাবিও উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘসহ অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করছে। সহিংসতা বন্ধে ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে আমরা বার্মার প্রতিবেশী দেশগুলোসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। তবে মায়ানমারের বিরুদ্ধে কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে না বলে জানান নোয়ার্ট।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন আমরা কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি; সম্ভাব্য কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে এখনই আমি কোন মন্তব্য করতে পারছি না। হবে কি হবে না- কোনটাই বলতে পারছি না।
মায়ানমার এমন একটি দেশ যেখান থেকে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন মন্তব্য করে দেশটিতে সাংবাদিক ও বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে দেশটিতে প্রবেশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন এ বিষয়ে সু চিসহ কোন নেতার সঙ্গে এখনও কথা বলেননি।
২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এ সংখ্যা উদ্বেগজনক। এর অর্থ হলো, সঙ্কট মোকাবিলায় আমাদের আরও উদ্যোগী হতে হবে এবং মায়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ভিভিয়ান তান। এ পর্যন্ত মায়ানমারের রাখাইনে দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা গত দুই সপ্তাহে ২ লাখ ৭০ হাজারে পৌঁছেছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ। এ পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ভিভিয়ান তান গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, আগের দিন পর্যন্ত তারা ১ লাখ ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা আসার কথা বলছিলেন। কিন্তু সীমান্তের নতুন কিছু এলাকায় শরণার্থীদের অবস্থানের তথ্য আসার পর ওই সংখ্যা এক লাফে অনেক বেড়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে এক লাখের বেশি মানুষ এসেছে- বিষয়টা এমন নয়। আমরা নতুন নতুন এলাকায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়ার খবর পাচ্ছি, যা আগে হিসাবের মধ্যে ছিল না।
গত ২৪ আগস্ট রাতে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্ট ও সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশ সীমান্তে শরণার্থীদের ঢল নামে। কক্সবাজারের কুতুপালং থেকে শুরু করে থাইংখালী পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে বাঁশ আর পলিথিনের অসংখ্য ঝুপড়ি গড়ে তুলেছেন এ রোহিঙ্গারা। তাদের নতুন বসতি দেখা গেছে টেকনাফ সীমান্তবর্তী হোয়াইক্যং ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও। মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চলে আসছে কয়েক দশক ধরে। বিভিন্ন সময়ে সহিংসতার মুখে সেখান থেকে পালিয়ে এসে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। এ দফায় তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারেন বলে দুদিন আগে ধারণা দিয়েছিলেন জাতিসংঘ কর্মকর্তারা।